পাইলস যখন সমস্যা

মূলত মলদ্বারের রক্তনালির সমস্যা পাইলস। মলদ্বারের রক্তনালি যখন ফুলে আঁকাবাঁকা হয়ে যায় এবং রক্তনালি ও মলদ্বারের দেয়ালের মধ্যবর্তী বন্ধন যখন দুর্বল হয়ে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে, তখনই পাইলস দেখা দেয়। অনেকে মনে করেন, পাইলস থেকে মলদ্বারে ক্যান্সার হতে পারে; কিন্তু সাধারণত তা হয় না। লিখেছেন ইবনে সিনা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের কনসালট্যান্ট ডা. মো. তৌহিদুল ইসলাম

পাইলসকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলে হেমোরয়েড। মলদ্বারের নিচের অংশে এক ধরনের রক্তের গুচ্ছ—যেটা ফুলে আঙুরের মতো হয়। তখন মলত্যাগ করলে বা মলত্যাগ না করলেও সেখান থেকে প্রায়ই রক্তপাত হয়।

প্রক্রিয়া
দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যে শক্ত মলত্যাগের ফলে মলদ্বারের রক্তনালিগুলো যে পেশির সাহায্যে মলদ্বারের দেয়ালের সঙ্গে আটকানো থাকে, সেই পেশিগুলো ছিঁড়ে যায় অথবা দুর্বল হয়ে যায়। ফলে মলদ্বারের রক্তনালিগুলো নিচের দিকে ঝুলে পড়ে। মলত্যাগের সময় যখন কোঁত দেওয়া হয়, তখন মলদ্বারের রক্তনালির মধ্যে রক্ত জমা হয়ে ঝুলে পড়া রক্তনালিগুলো ফুলে ওঠে এবং আরো বেশি ঝুলে পড়ে। এ ছাড়া ‘ম্যাট্রিক্স মেটালোপ্রটিনেজ’ নামের এক ধরনের এনজাইমের উপস্থিতি মলদ্বারের রক্তনালি ও মলদ্বারের দেয়ালের মধ্যবর্তী বন্ধন ধ্বংস করে রক্তনালিকে নিচের দিকে ঝুলে পড়ে পাইলস উৎপত্তিতে ভূমিকা রাখে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঝুলে পড়া রক্তনালিগুলো মলত্যাগের সময় কুণ্ডলী আকারে বাইরে বের হয়ে আসে, যা মলত্যাগ শেষে আবার ভেতরে ঢুকে যায়। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে বাইরে বের হয়ে আসা এই কুণ্ডলীগুলো হাতের সাহায্য ছাড়া আবার ভেতরে প্রবেশ করে না।

পর্যায়
প্রথম পর্যায় : মলদ্বার দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত পড়ে। এ সময় কোনো প্রকার মাংসপিণ্ড বাইরে বের হয় না।

দ্বিতীয় পর্যায় : মলত্যাগের সময় মলদ্বার দিয়ে মাংসপিণ্ড বের হয়ে আসে, পরে আবার ভেতরে ঢুকে যায়।

তৃতীয় পর্যায় : মলত্যাগের সময় যে মাংসপিণ্ড বাইরে বের হয়ে আসে, তা মলত্যাগের শেষে নিজে নিজে ভেতরে ঢোকে না; হাত দিয়ে ভেতরে ঢোকাতে হয়।

চতুর্থ পর্যায় : মাংসপিণ্ডটি সব সময় বাইরে থাকে, কখনো ভেতরে ঢুকবে না।

রোগ নির্ণয়
সাধারণত প্রক্টোসকপির সাহায্যে মলদ্বার পর্যবেক্ষণ করে পাইলসের অবস্থা, অবস্থান এবং পর্যায় নির্ণয় করা যায়। পাইলস ছাড়া অন্য কোনো রোগ সন্দেহ হলে কলোনোস্কপির সাহায্যে রোগ নির্ধারণ করা হয়ে থাকে।

চিকিৎসা
বিভিন্ন পর্যায়ের ওপর ভিত্তি করে পাইলসের চিকিৎসাপদ্ধতি নির্ধারণ করা হয়। তবে ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ চিকিৎসায় এখন আর অস্ত্রোপচার লাগে না।

জীবনধারা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন : খাদ্যাভ্যাস ও জীবনধারার পরিবর্তনের মাধ্যমে এই সমস্যা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।

ওষুধের সাহায্যে : মলদ্বারের পাইলস যদি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে, তাহলে নিয়মিত ওষুধ সেবনের মাধ্যমে দীর্ঘদিন জটিলতামুক্ত থাকা যায়। তাই মলদ্বারে পাইলসের কোনো লক্ষণ দেখা দেওয়া মাত্রই পাইলস বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন।

ইনজেকশনের মাধ্যমে : প্রাথমিক পর্যায়ের পাইলসের জন্য এই চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এটি একটি কার্যকর চিকিৎসাপদ্ধতি।

রাবার ব্যান্ড লাইগেশন : দ্বিতীয় পর্যায়ের পাইলসের জন্য এই চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। এই পদ্ধতিতে পাইলস কুণ্ডলীর গোড়ায় বিশেষ ধরনের মেশিনের সাহায্যে একটি রাবার ব্যান্ড পরিয়ে দেওয়া হয়। এক সপ্তাহ পর পাইলস কুণ্ডলীটি খসে পড়ে। এটি একটি ব্যথাহীন কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতি। এজন্য রোগীকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার দরকার হয় না।

হাতে কেটে অপারেশন : পাইলস কুণ্ডলীটি কেটে ফেলা হয়। ফলে মলদ্বারে ক্ষত সৃষ্টি হয়, যা শুকাতে ছয় থেকে আট সপ্তাহ সময় লাগে। এ সময় মলদ্বারে অনেক ব্যথা অনুভূত হয় বলে হিপবাথ (কুসুম গরম পানিতে ওষুধ মিশিয়ে পানিতে বসা) নিতে হয়।

লংগো অপারেশন : বর্তমানে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও কার্যকর একটি চিকিৎসাপদ্ধতি। এ পদ্ধতিতে পিপিএইচ নামের মেশিনের (একবার ব্যবহার করে ফেলে দিতে হয়) সাহায্যে পাইলস কুণ্ডলীটি কেটে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেলাই হয়ে যায়। ফলে মলদ্বারে কোনো ক্ষত সৃষ্টি হয় না এবং অপারেশন-পরবর্তী সময়ে হিপবাথ নেওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ পদ্ধতিতে অপারেশন-পরবর্তী সময়ে কেটে করা অপারেশনের চেয়ে অনেক কম ব্যথা অনুভূত হয়। ফলে রোগী অতি অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক কাজে ফিরতে পারে।

অন্যান্য চিকিৎসা
অন্যান্য আরো কিছু চিকিৎসাপদ্ধতি রয়েছে যেমন—ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশন, ট্রান্সএনাল হেমোরয়ডাল ডি-আর্টারিয়ালাইজেশন ব্যবহার করে পাইলসের চিকিৎসা। তবে আমাদের দেশে সাধারণত এই পদ্ধতির চিকিৎসাগুলো হয় না।

ইনফ্রারেড ফটোকোয়াগুলেশন পদ্ধতি : বিশেষ ধরনের যন্ত্রের মাধ্যমে তাপ প্রয়োগ করে পাইলস কুণ্ডলীতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালিটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এটি একটি ব্যথাবিহীন চিকিৎসাপদ্ধতি; কিন্তু বহুল ব্যবহৃত নয়।

ট্রান্সএনাল হেমোরয়ডাল ডি-আর্টারিয়ালাইজেশন : এটি পাইলসের নতুন চিকিৎসাপদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে ডপলার নামের যন্ত্রের সাহায্যে পাইলস কুণ্ডলীতে রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালি শনাক্ত করে সুতা দিয়ে বেঁধে দেওয়া হয়। এটিও বহুল ব্যবহৃত বা প্রতিষ্ঠিত চিকিৎসাপদ্ধতি নয়।

ঝুঁকি
সাধারণত স্থূলকায়, যকৃতের রোগী, বৃহদন্ত্রের প্রদাহজনিত কারণ, বৃহদন্ত্র ও মলাশয় ক্যান্সারের রোগী, মলদ্বারের আগের অপারেশন, আইবিএস ইত্যাদি রোগ থাকলে পাইলস হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। তবে যথাযথ চিকিৎসা না করালে পাইলসগুলো বড় হতে থাকে এবং নানাবিধ জটিলতার সৃষ্টি করতে থাকে। যেমন—

রক্তপাতের ফলে শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়।

কুণ্ডলী মলদ্বারের বাইরে এসে অবস্থান করতে থাকার ফলে কুণ্ডলীতে ঘা হয়ে মলদ্বারে প্রচণ্ড ব্যথা, মলদ্বার থেকে আঠালো রস নিঃসরণ হতে থাকে এবং মলদ্বার চুলকায়।

কুণ্ডলীতে রক্ত জমাট বেঁধে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভূত হতে পারে এবং রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে কুণ্ডলীটি পচে যেতে পারে।

প্রতিরোধে করণীয়
প্রচুর পানি পান ও তরলজাতীয় খাবার খান।

খাদ্যতালিকায় আঁশজাতীয় খাবার (সবুজ শাকসবজি, ইসবগুলের ভুসি ইত্যাদি) রাখুন।

মসলাজাতীয় খাবার, মাছ-মাংস কম খান।

মলত্যাগের সময় চাপ দেওয়ার অভ্যাস বা প্রয়োজনের অতিরিক্ত সময় টয়লেটে বসে থাকা ইত্যাদি বদ-অভ্যাস ত্যাগ করুন।

কোষ্ঠকাঠিন্য পরিহার বা দীর্ঘস্থায়ী কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসা করুন।

নিয়মিত বা প্রতিদিন মলত্যাগ করুন।

মলত্যাগের সময় অতিরিক্ত কোঁত দেবেন না।

নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করুন, অতিরিক্ত ওজন কমিয়ে আনুন।

দীর্ঘ সময় বসে কাজ করা থেকে বিরত থাকুন।

কোনো ধরনের অনিয়ম দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শমতো ওষুধ (মলদ্বারের মলম, ক্রিম, ঢুশ, ওষুধ ইত্যাদি) ব্যবহার করুন।